Monday, July 8, 2019

বাংলাদেশের ব্লগগুলির এখনও অনেক কিছুই দেয়ার বাকি : ব্লগার হাসান মাহবুব



বাংলাদেশের ইন্টারনেট ইতিহাসে ব্লগের যে ভূমিকা, সেটা নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। পুরোনো ব্লগগুলির বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে কিছু ব্লগ এখনও টিকে আছে এবং বেশ ভালোভাবে আছে। শুধু তাই না, কিছুদিন আগে সামহয়্যার ইন ব্লগের অ্যাপও বের হয়েছে। ইস্টিশন, চতুর্মাত্রিক, আমরা বন্ধু এই ব্লগগুলি হয়তো খুব জমজমাট অবস্থায় নেই, কিন্তু এখনও এখানে লেখা দিচ্ছেন ব্লগাররা। পরিমিত মিথস্ক্রিয়ায় স্পন্দিত হচ্ছে অন্তর্জালের হৃদয়।


কথা হচ্ছে, সোশাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন অ্যাপসের এই আগ্রাসানের যুগে কিছু মানুষ কেন এখনও ব্লগে আসছেন? শুধু যে আসছেন তাই না, খেটেখুটে লেখা তৈরি করছেন, যা সমৃদ্ধ করছে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডারকে। কেন আসছেন? তার আগে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে, অনেকেই চলে গেছেন কেন?

চলে যাবার পেছনে কারণ খুব সহজ। ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশাল মিডিয়া। এই বিশাল কোম্পানিগুলি প্রাযুক্তিক সুবিধায় এতটাই আয়েশ দিয়েছে মানুষকে, যা তাদের অলস করে তুলেছে। ফেসবুক কি আসলে লেখালেখির জন্যে তৈরি হয়েছিলো? না। ফেসবুকে মূলত মানুষ টুকরো কথা শেয়ার করবে, ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করবে বন্ধুদের সঙ্গে- এটাই ছিলো মূল উদ্দেশ্য। এখনও তাই আছে। তবে কোন এক বিচিত্র কারণে বাংলাদেশে ফেসবুকটাকে লেখালেখির জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন অনেকে।

আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু এই প্রশ্নও করি, ফেসবুকে আপনার লেখা কি যথাযথভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে? একটি ছয়শ শব্দের লেখায় আধা মিনিটের মধ্যে লাইক পেয়ে কি আপনি তৃপ্ত? যদি তাই হয়, খুব ভালো। চালিয়ে যান।

কিন্তু কিছু মানুষ অনুধাবন করতে পেরেছেন, ফেসবুকের সীমাবদ্ধ মাধ্যমটি লেখালেখির জন্যে খুব উপযুক্ত না। আর এজন্যে তারা ব্লগ ছাড়তে পারছেন না, অথবা ছাড়লেও ফিরে আসছেন।

আমি নিজে দশ বছর ধরে ব্লগিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমাকে কিছুদিন পরই পুরোনো ব্লগারদের কাছে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, 'ভাই, ব্লগে ফিরতে চাই, পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি, কী করবো?'

একটা ব্লগে আপনি ইচ্ছেমত হাইপারলিংক যুক্ত করতে পারবেন, ইউটিউবের ভিডিও এমবেড করতে পারবেন, লেখা ইচ্ছেমত বোল্ড বা ইটালিক করতে পারবেন, কোট দিতে পারবেন, যার কোনটিই ফেসবুকে নেই।

হ্যাঁ, ফেসবুক নোট নামে একটি সুবিধা আছে, যেখানে এই কাজগুলি করা যায়, কিন্তু নোট লিখলে আবার সবাইকে ট্যাগ না দিলে পড়বে না। তাই কার্যকর জিনিস হওয়া সত্ত্বেও ফেসবুক নোটের ব্যবহার নেই তেমন একটা।

একটা ব্যাপার বেশ মজার। বাংলাদেশে যে ধারার ব্লগিংয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা হলো কমিউনিটি ব্লগিং। পুরো পৃথিবীতে এটা বেশ অভিনব একটি ধারণা। ব্লগ বলতে মূলতঃ বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব ব্লগ অথবা ওয়ার্ডস্পট বা ব্লগস্পটে খোলা ব্যক্তিগত ব্লগ বোঝানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিটি ব্লগগুলিতে নিবন্ধন করে যে কেউ একটি নিজস্ব ঠিকানা পেতে পারেন, লিখতে পারেন, অন্যের লেখায় কমেন্ট করতে পারেন, এটা সত্যিই এক অসাধারণ ব্যাপার।

কোম্পানি ব্লগ অথবা পার্সোনাল ব্লগে এই মিথস্ক্রিয়া কোনভাবেই সম্ভব না। আপনি আপনার ব্যক্তিগত ব্লগে খুব চমৎকার একটি লেখা লিখলেন, সেটা হয়তো বা গুগলের সার্চ রেজাল্টে এক নাম্বারে থাকবে, সেটা থেকে হয়তো আপনি উপার্জন করবেন, কিন্তু আপনার লেখায় মন্তব্য করার মানুষ কই? সেটা আপনি বাংলাদেশের কমিউনিটি ব্লগেই পাবেন কেবল। আর এই কমিউনিটির শক্তি থেকেই গত এক যুগে খুব চমৎকার কিছু কাজ হয়েছে।

দশ বছর আগে ভাস্কর্য ভাঙার বিরুদ্ধে যেমন আন্দোলন জোরদার হয়েছিলো ব্লগ থেকে, এই কিছুদিন আগে ভিকারুন্নেসার ছাত্রীর আত্মহননের প্রসঙ্গেও ব্লগ ছিলো সরগরম। সেখানে আমার লেখা একটি পোস্টকে স্টিকি করা হয়েছিলো, যাতে মোট মন্তব্য পড়েছিলো ১৬২ টি! তাও আবার 'সহমত ভাই' জাতীয় মন্তব্য না। দীর্ঘ এবং সুচিন্তিত মন্তব্য।

১৯ ডিসেম্বরে দশম ব্লগ দিবসের প্রারম্ভে আমি তাই আশাবাদী, বাংলা ব্লগের আরো অনেক কিছু দেওয়ার বাকি এবং ব্লগাররা দিয়ে যাবেন আমাদের।

ব্লগ দিবস উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যেই ব্লগাররা নানারকম আয়োজনের কথা ভাবছেন, একত্রিত হচ্ছেন সেই দশ বছর আগের মতো! ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর ছোট ছোট ডিভাইসের অর্গল ভেঙে এই যে একসঙ্গে হওয়ার ইচ্ছে, এর মধ্যে ব্লগারদের প্রাণের প্রবাহমনতার চিহ্ন পাওয়া যায়।

মাঝখানে কিছু অনাকাঙ্খিত কারণে, কিছু অস্থিরতায় স্থবির ছিলো ব্লগ দিবসের কার্যক্রম। কিন্তু ব্লগাররা মিথস্ক্রিয়ার অসাধারণ সংস্কৃতি শুধু ব্লগেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না। ১৯শে ডিসেম্বর বাংলা ব্লগ দিবসে ব্লগারদের মিলনমেলায় হয়তো বা উদ্বোধন হবে নতুন চিন্তার, নতুন উদ্দীপনার!

ইত্তেফাক/নূহু

সাথে থাকুন হাসান ব্লগের

No comments: